জানাজার নামাজের নিয়ত, নিয়ম ও ফজিলত

মুসলিম সমাজে মৃত ব্যক্তির প্রতি সর্বশেষ সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে জানাজার নামাজ বা সালাতুল জানাজাহ। যা একটি ফরজ কিফায়া অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক আদায় করলে অন্যদের ওপর থেকে দায় সরে যায়, কিন্তু কেউ আদায় না করলে সকলেই গোনাহগার হয়। আজকের এই আর্টিকেলে জেনে নিন জানাজার নামাজের নিয়ত ফজিলত কি?সেই সম্পর্কিত সকল তথ্য। 

নিয়ত কি ও তা করা কেন প্রয়োজন 

নিয়ত” শব্দটি আরবি “নিয়াত”(نِيَّة) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো—ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য। ইসলাম ধর্মে প্রতিটি ইবাদতের মূল ভিত্তি হচ্ছে নিয়ত। হাদীসের ভারস্যমতে নিয়ত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে; “নিশ্চিয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভর করে”( সহীহ বুখারী: ১)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, যেকোনো ইবাদত আল্লাহর জন্য শুদ্ধ মনে এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে না করলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না।

জানাজার নামাজের নিয়ত এর ক্ষেত্রেও একই ভাবে অপরিহার্য। যদিও তা মুখে উচ্চারণ করা সুন্নত নয়, বরং অন্তরের ইচ্ছা বা মনোভাবই যথেষ্ট।

জানাজার নামাজের নিয়ত

সাধারণভাবে জানাজার নামাজের নিয়ত আরবি ভাষায় এভাবে করা হয়:

نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ عَلَى هَذَا الْمَيِّتِ أَرْبَعَ تَكْبِيرَاتٍ فَرْضَ كِفَايَةٍ لِلَّهِ تَعَالَى

বাংলা উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া আলা হাযাল মাইয়্যিতি আরবা’আ তাকবীরাতিন ফারদা কিফায়াতিল্লাহি তা’আলা।

বাংলা অনুবাদ: আমি নিয়ত করলাম, আল্লাহর জন্য এই মৃত ব্যক্তির ওপর চার তাকবীর সহকারে ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ আদায় করব।

জানাজার নামাজের নিয়ম

জানাজার নামাজের নিয়ত এর পাশাপাশি আমাদের জানা দরকার জানাজার নামাজের নিয়ম।আর যেহেতু জানাজার নামাজ প্রতিদিন পড়তে হয় না সেহেতু জানাজার নামাজের নিয়ত ও নিয়ম সম্পর্কে অনেকেই অবগত নয়।

জানাজার নামাজের নিয়ম:

  • ইমাম সাহেব প্রথম তকবীরের পর আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতেহা পাঠ করবেন।
  • এবং সাথে অন্য ছোট কোন সূরা পড়া মুস্তাহাব।
  • ইমাম সাহেব দ্বিতীয় তাকবীর দিবেন।
  • এর পর দরুদে ইব্রাহিম পাঠ করবেন।
  • তৃতীয় তাকবীরের পর দোয়া পাঠ।
  • এবং এরপর ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাজ শেষ করবেন “আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” বলে।

মুখে নিয়ত করা কি বিধাত

জানাজার নামাজের নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা অনেক আলেম দের মতে, তা ইসলামী শরিয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা তাদের মতে ইসলামী শরীয়তে নিয়ত, অন্তরের কাজ। যা মুখে উচ্চারণ করা বিধাতি কাজের অন্তর্ভুক্ত। 

“নিশ্চয়ই সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।”—(সহীহ বুখারী, হাদীস: ১; মুসলিম: ১৯০৭)

এই হাদীসটি-কে ইমামরা, (যেমন; ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ) তারা বলেন যে, জানাজার নামাজের নিয়ত বা অন্য সকল নামাজের নিয়তের ক্ষেত্রে, শুধু নিয়তের কথা বলা হয়েছে। তবে মুখে বলার কথা বলা হয়নি। সুতরাং, মুখে নিয়ত করাকে নবীর সুন্নাহ বলা যাবে না।

কেননা রাসূল (সা.) কখনো কোনো ইবাদতের শুরুতে মুখে নিয়ত করেছেন, এমন কোনো সহিহ হাদীস নেই। বরং রাসূল (সা.) এবং সাহাবারা ইবাদতের পূর্বে অন্তরে নিয়ত করতেন, মুখে উচ্চারণ করতেন না।

জানাজার নামাজের নিয়ত বা অন্যান্য নামাজের নিয়ত এর ক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণ করা থেকে অন্তরে নিয়ত করাই উত্তম।

জানাজার নামাজের ক্ষেত্রে অযুর শর্তাবলি

প্রতিটি নামাজের পূর্বে অযু পড়া আবশ্যক, জানাযার নামাজের পূর্বেও তার ন্যায় অযুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে নিতে হয়। কেননা অপবিত্র অবস্থায় জানাযা শুদ্ধ হবে না।

তাছাড়া কোনো ব্যক্তির উপর গোসল করা ফরজ হলে গোসল করে জানাযার নামাজে দাঁড়াতে হবে।

তবে অযুর ক্ষেত্রে যদি কোথাও পানির ব্যবস্থা না থাকে। তাহলে তায়াম্মুম করে নিতে হবে। বিখ্যাত তাবেয়ী নাফেঅ বলেন, আবদুল্লা ইবনু ওমর বলতেন, কেউ যেন বিনা অযুতে জানাজার নামাজ না পড়ে (মুঅত্তা ইমাম মালিক, ৮০ পৃষ্ঠা)।

আর কিছু পরিস্থিতিতে যদি অযু করতে গিয়ে জানাযা ছেড়ে যাবার আশংকা থাকে তাহলে ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, তুমি তায়াম্মুম কর এবং নামাজ পড় (মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, ৩য় খণ্ড, ৩০৫ পৃষ্ঠা)।

আত্মহত্যাকারী,বেনামাযী,ফাসেক ব্যক্তিদের জানাযা নামাজ কিভাবে হয়

ইসলাম আত্মহত্যাকারী, বেনামাযী বা যারা নামাজ পড়ে না ও ফাসেক ব্যক্তিদের জানাজার নামাজ নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। নিচে এই বিষয়ে কুরআন, সহিহ হাদিস ও ইসলামী ফিকহের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির জানাজার নামাজ

সাধারণ মুসলমানরা পড়তে পারেন তবে বড় আলেমরা এরিয়ে চলা উত্তম।

আত্মহত্যাকারী সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। আর কেউ সীমা অতিক্রম করে তা করলে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” — (সূরা আন-নিসা: ৪:২৯-৩০)

তাছাড়া আত্মহত্যাকারী দের সম্পর্কে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে সে আত্মহত্যার পদ্ধতি দিয়ে নিজেকে বারবার শাস্তি দেবে”(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৯)

ফিকহি মতামত

অধিকাংশ ফকীহ যেমন: ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি, ইমাম আহমদ বলেন;

যদি আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি মুসলমান থাকে তার জানাযা নামাজ পড়া যাবে। তবে সমাজের সম্মানিত বড় আলেম বা নেতা তার জানাযা পড়া থেকে বিরত থাকা উত্তম, যেন মানুষ পাপ থেকে সাবধান হয়।

তাছাড়া ইমাম নববী (রহ.) বলেন; আত্মহত্যাকারীর জানাযা নামাজ পড়া বৈধ, তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তা থেকে বিরত থাকতে পারেন।”__(আল-মাজমু, ইমাম নববী)

বেনামাজী ব্যাক্তির জানাজার নামাজ

বেনামাজী বা যে নামাজ অস্বীকার করে তাদের জানাজার নামাজ হবে না।

কেননা কেউ যদি নামাজ ফরজ বলে গণ্য করে না, বা তা অস্বীকার করে, সেই ক্ষেত্রে ঐব্যাক্তি ইসলামের বাইরে চলে যায়। অতপর থাকে অমুসলিম বলে গণ্য করা হবে।

নামাজ সম্পর্কে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন “নামাজ কায়েম করো, নামাজ অস্বীকার করো না, তা না হলে কুফরি হয়ে যাবে।”__(তিরমিজি: ২৬২২)

অলস বেনামাজি ব্যক্তিদের জানাজার নামাজ

জানাজার নামাজ হবে তবে বড় আলেমরা এবং সম্মানিত ব্যাক্তিগন এরিয়ে চলা ভালো, সমাজের শিক্ষার জন্য।

যদি কেউ অলসতা বা গাফিলতির কারণে নামাজ না পড়ে তাহলে সে ফাসেক, কিন্তু মুসলমান। সেই ক্ষেত্রে তার জানাযা পড়া যাবে, তবে বর্জনীয় মনে করে। সমাজের বড়রা সেই নামাজ এড়িয়ে যেতে পারেন।
নামাজে অলসতাকারী দের সম্পর্কে ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন; “যদি কেউ নামাজকে অবহেলা করে, অথচ অস্বীকার না করে, তবে সে মুসলিম হিসেবে জানাজা পাবে।”__ (আল-মুগনি)

সতর্কবার্তা হিসাবে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন; “আমার উম্মতের মধ্যে যারা বড় পাপ করবে, আমি তাদের জন্য সুপারিশ করবো।” — (তিরমিজি: ২৪৩৫)

আর যারা নামাজ অস্বীকারকার করে তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

ফাসেক ব্যক্তির জানাযা

জানাজার নামাজ হবে তবে সমাজের নেতৃত্ব দাতাগন এরিয়ে চলা ভালো

ফাসেক এমন ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে গুনাহ করে, যেমন: মদ খাওয়া, গান-বাজনায় লিপ্ত হওয়া, বা প্রকাশ্যে ব্যভিচার করা।

যদি সে তাওবা না করে মারা যায়, তবুও মুসলিম থাকলে তার জানাযা নামাজ আদায় করা হবে। তবে সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার জানাযায় অংশগ্রহণ না করে মানুষকে বার্তা দিতে পারেন।

ফাসেক ব্যাক্তি দের জানাজার নামাজ সম্পর্কে ইমাম আহমদ বলেন; “ফাসেক মুসলমানদের জানাযা পড়া যাবে, তবে ভালো লোকেরা না পড়লেও হবে।” — (আল-মুসনাদ)

গায়েবী জানাজার নামাজের নিয়ত ও নিয়ম

গায়েবী জানাজার নামাজের নিয়ত ও নিয়ম সাধারণ জানাজার নামাজের মতোই। তবে সেখানে শুধু মৃতদেহ উপস্থিত থাকে না।

গায়েবী জানাজা বলতে বোঝায়, যে মৃত ব্যক্তির মৃতদেহ উপস্থিত নেই, আর  তার জন্য জানাজার নামাজ আদায় করা। এটি একটি স্বীকৃত ইসলামী বিধান এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও তা আদায় করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময় কালে যখন নাজাশী বা আসহামা রাজা ইন্তেকাল করেন, তখন তার জানাজা রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত না থাকলেও মুসলিম সাহাবাদের নিয়ে তাঁর জন্য গায়েবী জানাজার নামাজ আদায় করেন __(সহিহ বুখারি: ১৩৩৩; এবং সহিহ মুসলিম: ৯৫১)

জানাজার ইমামতি কার করা উচিত

ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, জানাজার নামাজে ইমাম হওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার হচ্ছেন মৃত ব্যক্তির ওলী। যেমন ; পিতা,পুত্র, দাদা, ভাই, চাচা।

ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন ” অধিক হকদার ব্যক্তি ইমামতি করবে__ এটাই সুন্নত। যদি মৃতের ওলী উপস্থিত থাকে, তবে তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ ইমামতি করবেন না”__(আল-মুগনি, ২/৩৫৫)

তবে যদি মৃতের ওলী অনুপস্থিত থাকেন বা অন্য কাউকে অনুমতি দেন, তাহলে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, বড় আলেম, ক্বারী বা এলাকার সম্মানিত কোনো দ্বীনদার ব্যক্তি ইমামতি করতে পারেন।

মৃত ব্যাক্তি ঋণগ্রস্ত থাকিলে করণীয়

মৃত ব্যক্তির যদি কারো কাছে ঋণ থাকেন তাহলে তার ওয়ারিশগণ তা পরিশোধ করে দেবেন। আর যদি তারা অসচ্ছল হয় ও ঋণদাতা স্বচ্ছল হন তাহলে ক্ষমা করে দেয়াই হবে মহোত্তম কাজ।

আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত ;” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এক মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জানানো হলো যে, সে ঋণগ্রস্ত। তখন তিনি জানতে চাইলেন,’তার ঋণ আছে?’ সাহাবারা বললেন, ‘ হ্যা, দুই দিনার।’ তিনি বললেন,’ তাহলে তোমরা তোমার বন্ধুর জানাযা দাও'”( সহিহ মসলিম,হাদিস: ১৬১৯)

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত ” একজন ব্যাক্তি মৃত্যুবরণ করল, কিন্তু তার ঋণ ছিল। তখন রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তার ঋণ কে পরিশোধ করবে? ‘ একজন সাহাবি বললেন আমি পরিশোধ কিরবো।’তখন তিনি জানাযার নামাজ পড়ালেন।”(সুনান আবু দাউদ, হাদিস ৩৩৪৩)

শেষ কথা:

জানাজার নামাজের নিয়ত এই প্রতিবেদনটির কোনো কথা রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বি-র দ্বি তা-চরন হয়, তাহলে তা অগ্রহণযোগ্য।

আরো পড়ুন: হাদিস অনুযায়ী মেদের নাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top